সজীব জীবনের ধর্ম হচ্ছে বৃক্ষের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। গাছের পাতা ছিড়লে বা শাখা - প্রশাখা কাটলেই কিন্তু গাছটি মৃত্যু বরণ করে না। আহত, এমনকি মূমুর্ষ হয়েও কদিন পরে ঠিকই বেঁচে ওঠে। কীসের বলে বেঁচে ওঠে ? গাছের মূল যে মাটিতে প্রোথিত, তার রস ও আত্মশক্তিই গাছকে তার পাতা/ শাখা হারানোর বেদনা ভুলিয়ে তার ক্ষতচিহ্ন সারিয়ে তোলে। গাছটির মূল যে ভূমিতে প্রোথিত সে মাটিই তার স্বদেশ। স্বদেশের সাথে তার নিবিড় বন্ধনের কারণেই সে নানা ঘাত - প্রতিঘাত সহ্য করেও মাথা উচু করে সগৌরবে বেচেঁ থাকে। পরম ধৈর্য্য - দৃঢ়তা আর বেচেঁ থাকার অদম্য ইচ্ছাই তাকে বাচিয়ে রাখে। সে নিজ ও চারিদিকের পরিবর্তনকে ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে জীবনের জয়গানে মুখরিত থাকে। মানুষ আর গাছের জীবনে অদ্ভুত মিল আছে। যোা মানুষ তার স্বদেশের ভূমির সাথে সম্পর্ক রাখে, স্বদেশ - স্বভাষা - স্বধর্মের রসে সিক্ত তাকে। সে মানুষ শত ঘাত- প্রতিঘাত সত্বেও মাথা উচুঁ করে বেচেঁ থাকে। সে তাকে তরতাজা। সে আঘাতে - বিপদে - বিচ্ছেদে - শোকে - দুঃখে - দূর্ঘটনায় আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সে সফলতায় অতি উৎফুল্ল হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারায় না, আবার ব্যর্থতায় হাত -পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে না। সফলতা আর ব্যর্থতা তার কাছে একটা ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। আসলে, ঘটনায় আমাদের ভেতরে কী ঘটে, আমরা সুখ - দুঃখের আবেগ কী ভাবে সামলাই, সেটাই আসল বিষয়।
আর, যে মানুষ তার আত্মপরিচয়, নিজধর্ম, জাতীয় স্মৃতি ও ঐতিহ্য ভুলে যায়, স্বদেশপ্রেম হারিয়ে ফেলে সে হতভাগ্য। সে জীবমৃত। বিনাস আর ধ্বংসই তার পরিণতি। জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হয়, ঘাত -প্রতিঘাত সহ্যকরে, কঠিন সময়ে মাথা উুচুঁ করে আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিখতে হয়। আর, সে ক্ষেত্রে গাছের কাজ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। ভোরের প্রকৃতির দিকে খোলা মনে, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন কী সুন্দর, কোনো ভেজাল নেই। তার সবটুকুই খাঁটি। আমরা সব খাঁটি চাই।
মাটির মালিকানা থেকে শুরু করে দুধ - মধু - স্বর্ণ - বর্ণ ---- সবই খাঁটি চাই। শুধু নিজে খাঁটি হতে রাজি নই। কিন্তু, প্রকৃত সত্য হচ্ছে ----- মানুষ খাঁটি না হলে ঐসব খাঁটি হবে কি করে ? খাঁটি মানুষ পাওয়া আগেও কঠিন ছিল, এখন আরও কঠিন। কবি, সাহিত্যিক, লেখক,বুদ্ধিজীবি, ব্যবসায়ী, ডাক্তার আইনজীবী,ব্যবসায়ী, ইন্জিনিয়ার,রাজনীতিবীদ ---- সবই আছে। শুধু খাঁটি মানুষের অভাব। মানুষের সমাজে মানুষের অভাব --- এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। মানুষ নিজে খাঁটি হবার সাধনা না করলে কেউ তাকে খাঁটি বানাতে পারবে না। আমরা অনেকে এখন দেশে বসেই বিদেশী হয়ে যাই। আমাদের মুখের ভাষায় ভেজাল। আমরা বাংলার সাথে এতবেশি ইংরেজি শব্দ - বাক্যাংশ, এমনকি আস্ত আস্ত বাক্য ব্যবহার করি ,এ যেন দুধে পানি নয়, পানিতে দুধ মেশানো। আমাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি - ঐতিহ্য আমরা ভুলে যাচ্ছি অথবা অবহেলা করছি। অথচ, ঐতিহ্য - সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের - মানবসমাজের বিকাশের - বিজয়ের প্রকাশ , প্রবৃত্তি - প্রকৃতি - পরিবেশের ওপর বিজয়।
যাহোক, পরিস্থিতি যা- ই হোক মনটাকে সবুজ রাখুন। সবুজ প্রকৃতির দিকে গভীরভাবে, খোলা মনে তাকান। প্রকৃতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে আপনাকে আহবান করছে। সে আহবানে সাড়া দিন। আপনি প্রকৃতির অংশ হয়ে যান। বিশ্বাসী মানুষের আত্মা, হৃদয় আর শরীরের মাঝে ভারসাম্য আনে প্রকৃতি। প্রকৃতির সাথে একাত্মতা হৃদয়ে প্রশান্তি আনে। আর প্রশান্ত হৃদয়ই হচ্ছে সুখ- শান্তির আসল ফল্গুধারা। প্রকৃতি হচ্ছে মানুষের জন্য মহান আল্লাহর অপার করুণা আর দান। আসুন, এই দানকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। মনের দানবকে দমন করে, নিজেকে স্রষ্টায় সম্পূর্ণ সমার্পণ করে খাঁটি মানুষ হই।' জীবন একগ্লাস চিনির শরবত নয়, বরং টক - ঝাল - মিষ্টি আচার। আর চিনির শরবতেও লেবুর একটু টক রস না দিলে কিন্তু ভালো লাগে না। জীবনে সুখের অনুভব যেমন থাকে, তেমনি থাকে দুখের উপস্থিতি। জীবন যেন সুখের বাসর ; বেদনার বেলাভূমি। জীবনের বাঁকে বাঁকে, সকাল সাঁঝে, সুখ - দুঃখ একে অপরকে ধাওয়া করে। পথের ধারে গাছের ছায়ায় হিমেল হাওয়ায় ঘুমিয়ে যাওয়া ক্লান্ত পথিকও ঘুমের মাঝে সুখের সাথে দুঃস্বপ্নও দেখে। দুঃখ - সুখের দোলাচলে দুলছে এই মানব সভ্যতা, সেই আদিকাল থেকে। ভোরের স্নিগ্ধ আলো আর মিষ্টি রোদেও মৃত্যুর মিছিল থেমে থাকে না। আবার ঝড় আর বিরামহীন বৃষ্টি, এমনকি যুদ্ধের মধ্যেও নতুন মানব -শিশুর আগমন রুদ্ধ হয় না। জীবন কখনো কৃষ্ণচূড়া - রক্তজবার লালে রঙিন, কখনো নয়নতারা - হাসনাহেনার হাসিতে উচ্ছ্বল। আবার কখনো কানাবকের মতো ধূসর - মলিন, পানকৌড়ির কুচকুচে কালো পালকের মতো শোকাবহ, দুখী শিমফুলের মতো বেদনায় নীল। জীবনের এই সাদা - কালো- লাল - নীল সকল রঙ- ই চির সবুজ মানবাত্মার সজীব ক্যানভাসে আঁকা। ভালো - মন্দের দ্বন্দ্ব নিয়েই জীবন এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। জীবন গতি থেকে স্থিতি, শব্দ থেকে নীরবতায়, সসীম থেকে অসীমে লীন হয়ে যায়। সুখের রঙধনু জীবনের আকাশে ক্ষণকালই থাকে । রঙধনু সত্য নয়, জীবনটাই সত্য। তাই, বিশ্বাসের আলোয় পথ চলুন, জীবনকে উপভোগ করুন মাত্রা বজায় রেখে, সকলের সাথে মিলেমিশে।'